Munia Dada

- Agniva Dutta, IX DA, Techno India Group Public School, Balurghat


এক যে ছিল গ্রাম। গ্রামের পাশে একটা বিরাট সবুজ মাঠ আর তিরতির করে বয়ে চলা একটা ছোট্ট নদী। নদীর ওপাশে ঘন জঙ্গল। সেখানে থাকে মুনিয়াদাদা। কালো মেঘের মত তার গায়ের রং। টানা টানা চোখ। বাঁশির মত নাক। ঘাড় অবধি লম্বা কোঁচকা চুল। পরনে ছোট ধুতি আর হাতে বাঁশের বাঁশি। কার কাছ থেকে মুনিয়াদাদা বাঁশি বাজানো শিখেছে জানি না। তবে ও যখন বাঁশি তে ফুঁ দেয় তখন সমস্ত বন চুপ করে ওর বাঁশি শোনে। অনেকদিন আগে যখন মুনিয়াদাদা ছোট্ট ছিল তখন কি করে যেন জঙ্গলে এসে পড়েছিল। তারপর থেকে ওখানেই আছে। বনের সব পশুপাখি তার বন্ধু। সবাই মুনিয়াদাদা কে ভালোবাসে। মুনিয়াদাদাও সবাইকে ভালোবাসে। তাদের রক্ষা করে।
মুনিয়াদাদার সঙ্গে থাকে ভুলু কুকুর আর তিনটে কুচকুচে কালো মোষ। মুনিয়াদাদা গ্রামে গিয়ে মোষের দুধ বিক্রি করে আসে।
ওই বনেই বাবা মায়ের সঙ্গে থাকে ছোট ভোম্বা ভালুক আর জাম্বো হাতি। ওদের সাথে মুনিয়াদাদা আর ভুলু কুকুরের খুব ভাব।
একদিন হয়েছে কি, ভোম্বা ভালুকের বাবা আর মা বেরিয়েছে কোনো কাজে। যাওয়ার সময় বার বার করে ভোম্বাকে বলে গেছে যেন বাড়ি থেকে না বেরোয়। এদিকে মহুয়া ফল পেকেছে। মৌচাক ভর্তি মধু টলটল করছে। হরিণ বন্ধুরা মহুয়াতলায় জমা হয়েছে, দৌড়োচ্ছে, খেলা করছে আর মহুয়া খাচ্ছে। কয়েকজন আবার এসে ভোম্বা কে ডেকেও যাচ্ছে খেলার জন্য।
এদিকে বেলাও গড়িয়েছে। ভোম্বার খিদে পেয়েছে। তাই চুপি চুপি ভোম্বা বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে। মহুয়া তলায় এসে প্রাণ ভরে মধু খেলো। মহুয়া খেলো। তারপর গাছের ডালে গা এলিয়ে দিলো। একটু ঘুম ঘুম এসেছে। এমন সময় হরিণরা চিৎকার করে উঠলো ‘সাবধান সাবধান, বনে শিকারী ঢুকেছে। ‘ ভোম্বা চমকে জেগে উঠলো। কিন্তু পালাবার আগেই ওর পায়ে গরম কি একটা যেন ঢুকে গেলো| ভোম্বা গাছ থেকে ছিটকে মাটিতে পড়লো ।
ওর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন রাত। মা বাবা বন্ধুরা কেউ কোত্থাও নেই। পায়ে, মাথায় খুব ব্যথা। নড়তে গিয়ে বুঝলো ওকে একটা শিকল দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। নাকে পড়ানো হয়েছে একটা দড়ি। ভোম্বা কত কাঁদলো, বাবা, মা, মুনিয়াদাদা, ভুলু কুকুর, জাম্বো হাতি সব্বাইকে কত ডাকলো। কেউ সাড়া দিলো না ।
এদিকে বনে হুলুস্থুল পড়ে গেছে। ভোম্বার মা বাবা কাঁদছে। সবাই ভোম্বা কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কোনো খোঁজ খবর ও দিতে পারছে না। শুধু জানা যাচ্ছে, ভোম্বা মহুয়াতলায় গেছিলো আর তখন জঙ্গলে শিকারী ঢুকেছিল। মুনিয়াদাদা একদিন হলুদ পাখি কে ডেকে পাঠালো। ও তো ভোম্বার খুব ভালো বন্ধু। মুনিয়াদাদা ওকেই দায়িত্ব দিলো এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখার। যদি ভোম্বা কে কোথাও দেখা যায়। সবাই ভয় পেয়ে গেছে, যদি শিকারী ভোম্বা কে ধরে নিয়ে গিয়ে থাকে অথবা মেরে ফেলে থাকে!
বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো। ভোম্বা কে নিয়ে একটা লোক রোজ বের হয়। ও ভালুক নাচায়। ভোম্বা কি আর নাচতে পারে! নাকের দড়িতে টান পড়লে ও ব্যাথায় লাফিয়ে ওঠে, আর লোকে ভাবে ভালুক নাচছে। সারাদিন পর ওর খাবার জোটে পচা ভাত, আধপচা সবজি আর ফল। ভোম্বা ওগুলো মোটেও খেতে পারে না। রোগা আর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ও । ভোম্বা বসে বসে বনের কথা ভাবে। কি সুন্দর স্বচ্ছ জলের নদী ওদের। বনের পাকা ফল গুলো কত মিষ্টি। মৌচাক থেকে মধু খাওয়ার মজাই আলাদা। ভোম্বার কত বস্তু ওখানে। হরিণ, পাখি, জাম্বো হাতি, ভুলু, মুনিয়াদাদা সকলের কথা মনে পড়ে। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে বাবা আর মায়ের কথা। ওদের কথা না শুনে ভোম্বা কি যে ভুল করেছে! শিকলের ঘষা খেয়ে ভোম্বার পায়ে ঘা হয়ে গেছে। কোনোদিন যদি ছাড়া পায়, ও কি আগের মত ছুটতে পারবে, গাছে উঠতে পারবে! এই রকম একদিন খুব ভোরে ভোম্বা একটা মিষ্টি শিস শুনতে পেল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে পাতার আড়ালে ওর বন্ধু হলুদ পাখি বসে আছে। ভোম্বা আস্তে আস্তে হলুদ পাখি কে ডাকলো। ‘ হলুদ পাখি, হলুদ পাখি, আমি ভোম্বা, দ্যাখ!’
ভোম্বার গলা শুনে হলুদ পাখি পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে, সত্যি ই তো। এ তো ভোম্বা। যদিও অনেক রোগা হয়ে গেছে। লোম উঠে গেছে, কিন্তু আসলে তো ভোম্বাই ‘
হলুদ পাখি তাড়াতাড়ি উড়ে এসে ভোম্বার কাছে বসল। ‘ তুই এখানে কি করে এলি রে? সবাই তোকে কত খুঁজছে! চেহারা এত খারাপ কেন? তোকে আটকেই বা রেখেছে কেন ‘? ‘ আমাকে একটা শিকারী ধরে এনেছে, হলুদ পাখি ৷ আমাকে খুব কষ্ট দেয়। আমার নাকে দড়ি পরিয়ে দিয়েছে। ওটা টানলে কি ব্যথা লাগে জানিস! আমাকে ঠিকমতো খেতেও দেয় না। তুই বনে খবর দে। কেউ যদি আসে আমাকে উদ্ধার করতে ‘! ভোম্বার কথা শুনে হলুদ পাখি উড়ে গেলো বনের দিকে। মুনিয়াদাদা আর ভোম্বার বাবা মা কে সব জানালো। সঙ্গে সঙ্গে মুনিয়া দাদা তো তার তীর ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেলো| ভোম্বার বাবা মা ও সঙ্গে যেতে চাইলো| কিন্তু ওরা তো অত তাড়াতাড়ি চলাফেরা করতে পারবে না। তাই মুনিয়াদাদা সঙ্গে নিল ভুলু কুকুর আর জাম্বো হাতি কে। ভুলু কুকুর তো রাগে ফুঁসছে। আর রেগে গেলে ওকে দেখলে ভয় লাগে। সেদিন রাতে যখন চাঁদ উঠল, হলুদ পাখি রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চললো আর তার পেছন পেছন নিঃশব্দে ছায়ার মত চললো ভুলু কুকুর। মুনিয়া দাদা আর জাম্বো হাতি তার পেছনে।
রাত শেষ হয় হয়, মুনিয়াদালা পৌঁছোলো সেই বাড়িতে যেখানে ভোম্বা বন্দি ছিল।
মুনিয়া দাদা ঘরে ঢুকে শিকারীকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। সামনে কালো ছায়ার মত তিরধনুক হাতে মুনিয়া দাদা, ভুলু কুকুর আর জাম্বো হাতি কে দেখে ও ভয়ে চিৎকার করতেও ভুলে গেলো। নুনিয়াদাদা তাড়াতাড়ি ভোম্বার বাঁধন খুলে দিয়ে ওকে জাম্বোর পিঠে তুলে দিলো। ভুলু তখন শিকারী কে পাহারা দিচ্ছে। ওর নড়ার ও সাহস নেই। মুনিয়া দাদা জাম্বো কে বললো ‘ওর বন্দুকগুলো আমি এনে দিচ্ছি, ওগুলো পা দিয়ে ভালো করে পিষে দে তো। যাতে আর কাউকে গুলি করতে না পারে।’ আর শিকারী কে বললো ‘এবারের মত তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, আর কোনোদিন যেন তোমাকে জঙ্গলের আশেপাশে না দেখি।’
তারপর আর কি, পরের দিন রাতে হলুদ পাখি জাম্বো, ভোম্বা মুনিয়াদাদা আর ভুলু জঙ্গলে ফিরে এলো। সকালবেলা টা একটু লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। কারণ সাধারণ মানুষ কে ওরা ভয় দেখাতে চায়নি।
ভোম্বার মা বাবা ভোম্বাকে ফিরে পেয়ে খুব খুশি। তারপর সবাই মিলে হল এক মহাভোজ। তাতে মধু, দুধ, টাটকা ফল, ক্ষীর কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। সেদিন ই চার বন্ধু, মুনিয়াদাদা, ভুলু, ভোম্বা আর জাম্বো প্রতিজ্ঞা করল তাদের জঙ্গলে আর কোনো অন্যায় আর কোনোদিন তারা হতে দেবে না। এই বন কে রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব। হলুদ পাখি অবশ্য ভোজসভাতে থাকতে পারেনি। ও ফিরে গেছিলো ওর বাসাতে, বাচ্চাদের কাছে।