Joto Shob Bhoutik Kando

- Briti Saha, Class V Daffodil, Techno India Group Public School, Balurghat


সকালবেলা উঠে দেখি বড় মামা চোখ গোল্লা-গোল্লা করে বড় মামীর দিকে তাকিয়ে তাকে এক গামলা পেয়ারা পাতা আনার কথা বলছে । বড় মামাকে এত রেগে থাকতে মনে হয় প্রথমবার দেখলাম । তাও কৌতুহল বসত: তাকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম ‘কি হয়েছে মামা?’ বড় মামার ওই ড্যাবড্যাব চোখ করে বললেন, “দাতে বড্ড ব্যথা রে মাইরি। তিনি বললেন, চাংড়িপোতাতে খুব ভালো এক কবিরাজ থাকেন, তাকে ডেকে আনতে হবে” । আমি বললাম ‘চাংড়িপোতা? সে তো অনেক দূর! কে যাবে সেখানে? মামা বলল, “তুই যাবি”। তোর ঘোড়াও হয়ে যাবে। আমি বললাম, “আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে পাঁচ টাকা দিতে হবে”। মামা আর কোন উপায় না পেয়ে আমাকে গোটা পাঁচ টাকা দিয়ে দিলেন।
আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম কারণ সেখানেই আমার দাদু বাড়ি। ট্রেনে উঠে জানলার ধারে বসে ছিলাম আমি৷ তিন ঘন্টা পর মনে হল পেছন থেকে কেউ ডাকছে। আবার তখনই ট্রেনটা থেমে গেল৷ আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। পেছনে তাকাতেই দেখলাম একটি লোক আমাকে ডাকছে। লোকটিকে খুব চেনা চেনা লাগলো কিন্তু তাও আর কি চিনতেই পারছি না। আমি বললাম, “নীল না”? সে বলল, হ্যাঁ? আমি নেই। চিনতে এত সময় লেগে গেল৷ আমি বললাম দশ বছর কি আর কম কথা! নীল কোনোভাবে চেপেচুপে আমার পাশে কোনরকমে বসে গেল আমি জিজ্ঞাসা করলাম ট্রেনটা বন্ধ হয়ে আছে কেন? নীল বলল সামনের স্টেশনে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ট্রেনটা ছেড়ে দেবে। আমি ভাবলাম যাই বাইরে গিয়ে দেখে আসি। কিন্তু বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই আর যেতে পারলাম না, নীলের কথা মত ঠিক ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট পর ট্রেন ছেড়ে দিল। আমি একটু অবাকই হলাম। ট্রেন টা নীলের কথা মত ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই ছেড়ে দিল। যাইহোক নীলের হাতে একটা খাম দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ওই খাম কেন এনেছিস? ও বলল, “সুধার জন্মদিন কাল তাই এটা নিয়ে যাচ্ছি ওকে দেব। আমি ভাবলাম অনেকদিন সুধার সাথে দেখা হয়নি এবং তার জন্মদিন তাই তার সাথে দেখা করে আসি, কবিরাজের বাড়ি তারপরেও
যাওয়া যাবে।
চাংড়িপোতাতে এসে দুজনেই নামলাম। আমাদের সুধার বাড়িতে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। আমরা গিয়ে দেখলাম বাড়িতে কেউ নেই এবং তালাবদ্ধ। চারিদিক অন্ধকার। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজির পর নীল তার পকেট থেকে চাবিটা বের করে তালা খুলল। আমি নীলকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আজ সুধার জন্মদিন! কিন্তু তারা সব কোথায়? সে জানালো, জেঠুর শরীর খারাপ তাই কাকু কাকিমা ও সুধা সেখানে গেছে । তারা বলেছে ফ্রিজের থেকে খাবার বের করে খেয়ে নিতে। আমি তাও একবার সুধার মাকে ফোন করলাম। সুধার মা ও ফোন তুলে বলল সে তার বাবার বাড়িতে গেছে এবং ফ্রিজে যা খাবার আছে তা দুজনে ভাগ করে খেয়ে নিতে । এর মাঝে নীল পুকুর পাড়ে গিয়েছিল। আমিও সব খাবার-দাবার রেডি করে সেখানে চলে গেলাম। এসবের মাঝে আমি একেবারে বড় মামার কবিরাজ্যের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।

আমি যে এক ভীতু সেটা আমাদের গোটা গ্রাম জানে। নীলের সাথে গল্প করতে গিয়ে হঠাৎ ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। সেই একবার এক নাটক দেখার জন্য আমাদের ঠাকুমার কাছ থেকে দুই টাকা নিয়ে আমি এবং নীল রওনা হলাম। রাতের ট্রেন তাই একটু ভয় ভয় লাগছিল। তবে নীল যেহেতু সাথে ছিল তাই সাহস পেলাম। ট্রেন থেকে দু চারজন নামলো কিন্তু কেউই আমাদের সাথে নাটক যায়নি। আমার এতই ভয় লাগছিল যে আমি নীলের হাত ধরে রাস্তায় চলছিলাম। এরই মধ্যে পথে একটি শ্মশান ঘাট পরে। সেই জায়গাটায় প্রায় চোখ বন্ধ করে চলার মত গা ছমছম করছিল। রামরাম আওড়াতে আওড়াতে পেরিয়ে এলাম। এরপর রাস্তার পাশে তাঁবু খাটানো মাঠটিতে এসে পড়লাম। চারিদিকে প্রচুর লোক।সেখানে নাটকটা মঞ্চস্থ হচ্ছিল। নাটকটা প্রায় শুরুই হয়ে গিয়েছিল, আলো আঁধারের মধ্যে দর্শকাসনে নিজেদের দুটি সিট খুঁজে বসে পড়লাম। প্রায় দু’ঘণ্টা নাটক দেখে বাড়ির ফেরার পথ ধরলাম। সেই শেষবারের মতো নীলের সাথে দেখা! তারপর সে যে কোথায় গেছিল, কে জানে! দীর্ঘ কুড়ি বছর তার সাথে আর দেখা হয়নি।


যাইহোক আমরা খাওয়া শেষ করে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লাম। ছোটবেলার গল্প যেন শেষ ই হয় না। সেই খেলার মাঠ, বন্ধুরা মিলে কাবাডি খেলা পুকুরে স্নান, আরো কত কি। কখন যে চোখ লেগে গেছিল টের পায়নি। চোখে আলো এসে পড়তেই ঘুম ভেঙে দেখি, আমি আমার কলকাতার ঘরে একলাই শুয়ে আছি। দৌড়ে গিয়ে বড় মামীকে জিজ্ঞেস করলাম, “মামা কেমন আছে গো? মামি একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি আবারও বললাম বড় মামার দাঁত ব্যাথাটা কেমন আছে? মামি বলল – ও মা! সে তো এক মাস আগে দাঁত তুলে দিব্যি এখন মাংসের হাড় চিবোচ্ছে। আমি আবার ছুটে নিজের ঘরে ফিরে আসলাম। কোথায়ানীল তো কোথাও নেই। তারপর হঠাৎ টেবিলের ওপর চোখ পড়তেই দেখি নীলের হাতের সেই সাদা খামটি। দৌড়ে টেবিলের কাছে গিয়ে খামটা হাতে নিলাম। খামটা খুলে দেখি ভেতরে একটা চিঠি। কিছুটা ভয়ে, কিছুটা হতভম্ব হয়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম, “Neel expired ten years back in an accident”. আমার দুচোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো। কিন্তু সারাদিন একটাই প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল- কাল রাতে আমার সাথে, আমার পাশে ওটা কে ছিল?