Bohumaatrik

-Utsaneer Dutta, Class VIII Orchid, Techno India Group Public School, Balurghat


এ.সি দাস রোডের কানা গলিটার শেষ বাড়ির একতলার কোনের ঘরটি বড়ই স্যাঁতসেঁতে। আলো বাতাস প্রায় আসে না বললেই চলে। এই ঘরটিই আপাতত শৈলেনের বর্তমান ঠিকানা। গ্রামের বাড়ি উত্তরবঙ্গের এক অখ্যাত পাড়া গাঁয়ে। গাঁয়েরই স্কুল থেকে পাস করে শহরে কলেজে এসে গ্র্যাজুয়েশন করার পরে আর পড়াশোনা চালানো সম্ভব হয়নি শৈলেনের। বাড়িতে বিবাহযোগ্যা দুই দিদি, ছোটভাইটি শারীরিক প্রতিবন্ধী, মায়ের হাই ব্লাড প্রেসার আর বাতের ওষুধ চলে নিয়মিত। এতকিছু সামলে শৈলেনের উচ্চশিক্ষার খরচ যোগাতে পারেননি তার বাবা। গ্রামে গ্রামে সাইকেলে চেপে জামাকাপড় ফেরি করেন তিনি ৷
একদিন সন্ধ্যায় ফিরে এসে শৈলেন কে ডেকে বললেন, “ আজ ১০০-টি টাকারও বেচাকেনা হয়নি ৷ গ্রামের লোকেরাও এখন ফেরিওয়ালার কাছ থেকে জামা কাপড় কিনতে চায় না। এই বয়সে সাইকেল টেনে বেশি ঘুরতেও পারি না। জানিনা কতদিন এভাবে সংসার চালাতে পারবো। তোকে তো সাধ্যমত লেখাপড়া শিখিয়েছি। এবারে তুই একটু সংসারের হাল ধর। ” সেই রাতে শৈলেন অনেক ভেবেছে। আস্ত একটা বিনিদ্র রাত পার করে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবার তাকে শহরেই পাড়ি দিতে হবে। সেখানে গিয়ে ঠিক একটা কাজ জুটিয়ে নেবে সে আর অবসর সময়ে বাড়ি-বাড়ি ছাত্র পড়িয়ে যেটুকু রোজগার হবে তা থেকেই মায়ের ওষুধের ও ভাইয়ের পড়ার খরচ পাঠাতে হবে তাকে ।
দিন সাতেকের মধ্যে শহরে থাকা গ্রামের এক দাদার সাথে যোগাযোগ ক’রে সব ব্যবস্থা করে শৈলেন । একটা টিনের তোরঙ্গে দু-সেট জামাকাপড় আর কাঁথা – বালিশ ভরে নিয়ে সে চলে আসে শহরে জীবন সংগ্রামে যোগ দিতে। কিন্তু কিন্তু সেই টিনের তোরঙ্গের এক কোনে তার সাধের বাঁশিটি-ও সে সাথে করে এনেছিল তার জীবন সংগ্রামের একযাত্র সঙ্গী হিসাবে।
শৈলেন এখন এক মুদির দোকানে মালপত্র মাপা ও হিসেব লেখার কাজ করে। সকাল আটটা থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত হিসেব লেখা, মালিকের ফরমাশ খাটা ও দিনের শেষে হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরতে- ফিরতে প্রায় রাত দশটা বেজে যায়। সকালে রেঁধে রাখা জল দেওয়া ভাতগুলো কোনরকমে গলা দিয়ে নামিয়ে ক্লান্ত শৈলেন বিছানায় এলিয়ে পড়ে। রাতটুকু পার হতেই আবার তার ঠিকানা হয় মুদি দোকানের মালপত্রে ঠাসা ঘরটির ঘুপচে এক কোনায়। এই আলোহীন দমবন্ধ জীবনের ক্লান্তি কাটাতে কোনো কোনো দিন রাত গভীর হলে সে তার তোরঙ্গ থেকে বের করে প্রিয় বাঁশিটিকে। কানাগলির উঁচু প্রাচীর ছাড়িয়ে সেই বাঁশির সুর ছড়িয়ে যায় ও পাশের মুক্ত পৃথিবীর ফাল্গুনের ফুলবনে, চৈত্রের উদাসী হাওয়ায়, বৃষ্টির ছন্দে অথবা শীতের কুয়াশায় ।
সেদিন শহরে ধর্মঘট। দোকানপাট সব বন্ধ। সকালের একচিলতে নরম আলো প্রাচীরের কোনো এক ফোঁকর দিয়ে এসে পড়েছে শৈলেনের জানালায়। তোরঙ্গ থেকে বাঁশিটি বের করে তাতে সুর তুলছিল শৈলেন। হঠাৎ দরজায় এক ভিখারীর আগমন। পরনে গেরুয়া বস্ত্র, মাথায় জটা, হাতে ভিক্ষার ঝুলি। ঝুলির মুখটি ফাঁক করে সেই যোগী স্নেহ যাখা স্বরে শৈলেনকে বললেন, “ কুছ তো দে দো বেটা, যো কুছ ভি তেরা হ্যায়” । সেই গলার স্বরে অদ্ভূত কি একটা ছিল শৈলেনের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। সে বলল “ আমি কি দেবো বাবা? আমার কি ই বা আছে? আমি যে নিজেই বড় গরীব। ” মৃদু হেসে যোগী ভাঙা বাংলায় বললেন বললেন, “ না দিতে পারিস তো কুছ লে লে ইস ঝুলি সে।”
শৈলেন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,“কি আছে তোমার ঝুলিতে ? ”
মুক্তি অউর কামেয়াবি। উঠা লো কিসি এক কো। ” – বললেন সেই যোগী।

শৈলেন বলল- “ জীবনের লড়াই লড়তে লড়তে আমি বড় ক্লান্ত, বাবা। এ থেকে তো আর আমার মুক্তি নেই,যতদিন না নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছি।
“যেমন তুমার মর্জি।”
স্মিত হেসে বিদায় নিলেন যোগী। সেই রাতেই এক অদ্ভূত অনুভূতি হলো শৈলেনের। ঘর ভর্তি এক প্রচণ্ড আলোর ঝলকানিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখ ঝলসানো সেই আলোয় ঘরের সমস্ত কিছু চলে গেলো তার দৃষ্টির বাইরে । ছুটে পালাবার জন্য দরজাটিকেও খুঁজে পেলো না সে। ভীষন সেই আলোর আঘাতে চোখ যেন অন্ধ হয়ে গেলো তার। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে।
[2]
সকালের নরম আলো মুখের উপর এসে পড়তে ঘুম ভাঙলো মিস্টার শৈলেন মুখার্জীর। বেডসাইড টেবিলের উপর টি- সেট নামিয়ে রেখে, বড় বড় কাঁচের জানালা গুলির ভারী পর্দা একপাশে সরিয়ে দিচ্ছিলেন তার মা। সকালের রোদে মায়ের হাতের সোনার চুড়িগুলি চকচক করছিল। গতকাল রাতে ভালো ঘুম হয় নি শৈলেনের। মাথাটা ভার হয়ে আছে। অলস হাতে চায়ের কাপটি নিতেই দরজার বাইরে থেকে ভেতরে আসার অনুমতি চাইলো তার পি.এ । অনুমতি পেতেই বেঁটে-খাটো, গোল-গোল পরিপাটি পোশাক পরিহিত মানুষটি এসে জানিয়ে দিয়ে গেলো শৈলেনের সারাদিনের কর্মসূচি। লাঞ্চ ব্রেকের আগে অন্তত তিনটি মিটিং সারতে হবে বিভিন্ন কোম্পানির বড় কর্তাদের সাথে। দুপুরের ফ্লাইটে দিল্লি গিয়ে সন্ধেবেলা বৈঠক রয়েছে সরকারি আমলাদের সাথে। তারপর সেখান থেকে যেতে হবে মুম্বই। রাত এগারোটায় আবার ফ্লাইট । যেতে হবে জার্মানির বার্লিন শহরে। প্রায় ১২ ঘণ্টার জার্নির ধকল । জেট ল্যাগ হলেও বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশ নেই ।
সারাদিনের পুরো প্ল্যানটা যাথার মধ্যে ছকে নেওয়ার জন্য শৈলেন মুখার্জী চোখ বুজতেই ভেসে ওঠে একটা অন্ধকার কানাগলি, স্যাঁতসেঁতে একটা ঘর,তোবড়ানো টিনের বাক্স, মালপত্রে ঠাসা একটা দোকান ঘর আর এই সবকিছুর মাঝে খুব পরিচিত একটা মানুষের অবয়ব। কেমন যেন অস্বস্তি হয় তার। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। স্নান করে খুব ভালো করে মাথাটা হালকা করা চাই ।
বার্লিন যাবার ফ্লাইটটা ধরার জন্য মুম্বই এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিল শৈলেন। কি একটা কারনে বিমান উড়তে ঘণ্টা দুয়েক দেরি হবে। ওয়েটিং লবির এক কোণে বসে ক্লান্ত শৈলেন চোখ বুজে নিজেকে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিতে চায়।
কিন্তু এ কি! চোখ বুজতেই সেই একই দৃশ্য যা সে সকালে বিছানায় বসে দেখেছিল। একের পর এক ঝলসে উঠছে টুকরো টুকরো নানান ছবি – পুরোনো সাইকেলে কাপড়ের গাঁঠরি, শীর্ণ বাতগ্রস্ত অকালবৃদ্ধা এক মহিলা –কার সাথে যেন ভারী মিল তার মুখের, গেরুয়া বসন পরা জটাজুটধারী এক সন্ন্যাসী আর খুব চেনা একটা বাঁশির সুর।সেই সুর অতি মৃদু কিন্তু ওয়েটিং লবির সব হৈচৈ চাপা পড়ে যায় তার মূর্ছনায় । এই দৃশ্য গত কয়েক মাস যাবৎ তাড়া করে বেড়াচ্ছে শৈলেনকে, যেন দুঃস্বপ্নের মতো ; যেন কি একটা বার্তা দিতে চাইছে দৃশ্য গুলো, যেন ধরি ধরি করেও ধরা যায় না তার অর্থ। আবার ঝলসে ওঠা সেই আলো। আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় শৈলেনের, মুছে যায় তার বর্তমানের চেতনা। আলোময় সেই অন্ধত্বের মাঝে যেন ফুটে ওঠে অতি পরিচিত অথচ অজ্ঞাত সেই তরুণের অবয়ব- হাতে তার বাঁশি । কে এই তরুণ? কেন এত চেনা তবু অধরা সে? খুব ভালো করে দেখার চেষ্টা করে শৈলেন তাকে। একি। এ যেন তার নিজেরই মুখ । অবিকল, একই রকম চোখ,মুখ,হাত,পা এমনকি ছোটবেলায় কপালের কেটে যাওয়া ক্ষত দাগটিও। কিন্তু বড় মলিন তার বেশ, বড় করুণ তার মুখখানি, চোখ দুটি যায়াময়। আজ শৈলেন জানবেই তার পরিচয়। মুখোমুখি শৈলেন আর তার প্রতিবিম্ব। নিখুঁত প্রতিবিম্ব। তবুও যেন অন্য জগতের বাসিন্দা। সে জগৎকে শৈলেন চেনে না। শুধু দেখেছে তার খন্ডচিত্র আর শুনেছে বাঁশির সেই অশ্রুতপূর্ব ধ্বনি। এবারে গুনগুনিয়ে ওঠে শৈলেনের সেই প্রতিবিম্ব । বাঁশির সুরে সুর মিলিয়ে ছেলেটি গাইছে’ পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায় ও সে চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়…’

যেন মিনিট দুই-তিনেক,তারপরেই পূর্ব চেতনায় ফিরে আসে শৈলেন। বিমান ওড়ার সময় হয়ে এসেছে যাত্রীদের লাইনে দাঁড়িয়ে শৈলেন ভাবতে থাকে একেই কি আধুনিক পরিভাষায় বলে’ মাল্টিভার্স
কনশাসনেস’ বা অস্তিত্বের বহুমাত্রিক চেতনা? উত্তর অমীমাংসিত।