জানলার ধারে বসে অধীরমনে কিছু দেখছিল প্রবীর। হয়তো ভেসে গিয়েছিল বাইরের মুষলধারে পড়তে থাকা বৃষ্টির সাথে সেই শৈশবের দ্বারপ্রান্তে। প্রবীর পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার, কাজের সূত্রে স্ত্রী-পুত্রের সাথে ব্যাঙ্গালোরে থাকে। বাবার শরীর খারাপ হওয়ার কারণে দু ভাই-বোন দেশে ফিরেছে। ছোট ভাই সন্দীপ বিদেশে থাকে স্ত্রীর সাথে। আর পিংকির তো বিয়ে হয়ে গেছে, স্বামীর | সাথে কলকাতাতেই থাকে।
বাবার একটা ওষুধের প্রয়োজনে সন্দীপ দাদার কাছে এসে প্রবীরকে এক মনে বাইরের দিকে | তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
– কী দেখছিস-রে দাদা ?
— কী দেখছি? দেখছি আমাদের ফেলে আসা শৈশবকে … দেখ বাবানরা কি রকম বৃষ্টির মধ্যে খেলা করছে। তোর মনে আছে আমাদের ছোটবেলার কথা?
– তা আবার মনে থাকবে না? বৃষ্টির মধ্যে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলা। সে এক আলাদাই আনন্দ | ছিল,কাদার মধ্যে আছাড় খেয়ে আবার উঠে ফুটবল নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে আবার আছাড় খাওয়া…
—ফুটবল খেলার পর বৃষ্টির মধ্যে পুকুরে হুটো-হুটি করা, গাছে উঠে সেখান থেকে পুকুরে লাফ মারা, ঐ জিনিসটা এখনকার সুইমিংপুলকেও হার মানাবে।
– তারপর, স্কুল থেকে ফেরার সময় বৃষ্টি পড়লে প্রথমে কচুপাতাকেই মনে হতো পুরো শরীর বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট। যদিও সেই শেষমেশ কাকভেজা হয়েই বাড়ি ফিরতে হতো।
—
– আর ফিরেই জুটতো মায়ের বকুনি, “ঠান্ডা লেগে জ্বর আসবে এক্ষুনি, একটু দাঁড়িয়ে গেলে হতো না তোদের!”
—
– তারপর সেই বৃষ্টির মধ্যে গাছের আড়ালে ছিপ ফেলে মাছ ধরার জন্য বসে থাকাটা?
সেই সেবার মনে আছে, পিংকি গেছিল আমাদের সাথে খেলতে, গিয়েই কাদায় আছাড়। সে কি কান্নাকাটি… দুজন মিলে ওকে থামাতে পারি না৷
কথাটা বলতে বলতেই ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা- জানালা দিয়ে দেখা গেল প্রবীরবাবুর ছেলে বাবান | পড়ে গেল আছাড় খেয়ে।
চল দেখ, আবার কোথায় লাগলো ওর! আজ বাবানটা বৌদির কাছে ভালো রকম খাবে মনে হয়।
আরে যাস কোথায়?
আমরা কম আছাড় খেয়েছি ? কিছু হয়েছে? হয়নি তো… ওর ও কিছু হবে না। ওখানে সব সময় বাড়ির মধ্যেই থাকে, কাদার মধ্যে আছাড় খাওয়ার মজাটা একটু বুঝতে দে।
হা… হা… হা…
ছোটবেলায় বৃষ্টি পড়লেই আলাদা একটা আনন্দ ছিল… আর এখন, বৃষ্টি পড়লে আনন্দ তো দূরের | কথা বিরক্ত লাগে, কাজে যাবে না বৃষ্টির মধ্যে সেই ভয়ে!
– আজ কতদিন পর বৃষ্টির এই আনন্দটা উঠতে দিচ্ছে না জানলা ছেড়ে। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই বৃষ্টির দুপুরের খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজাকে।
বাই দ্যা ওয়ে, কি রান্না হচ্ছে রে আজ?
পাশ থেকে কেউ একজন উত্তর দেয়,
– খিচুড়ি, ইলিশ ভাজা, পাপড় ভাজা আর বেগুন ভাজা। (পিংকি অলক্ষ্যেই কখন যে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ লক্ষ্যই করেনি) আরে তাড়াতাড়ি খাবি চল, না হলে ঠান্ডা হয়ে যাবে যে আমার পড়ে যাওয়ার গল্প পরে করবি…
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা ইলিশের গন্ধ আর বাজতে থাকা মিষ্টি মধুর সুর বৃষ্টির দুপুরটাকে কখন | যে দুই দশক আগের দুপুর এ ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না….
“বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি
এ কোন অপরূপ সৃষ্টি,
এতো মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি
আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি।”
Leave a Reply