বৃন্দাবন নামক ছোট্ট এলাকায় যেন প্রকৃতির কোলেই শুয়ে আছে। সবুজের সমারোহে ঘেরা এই এলাকায় যেন কোনো এক অজানা মায়া জালে স্পর্শে সবার কাছে প্রিয়। এই এলাকায় রয়েছে একটি ছোট দিঘি, যাকে এলাকায় সবাই “মায়ার দিঘি” বলে ডাকে। মায়ার দিঘির জল এতই স্বচ্ছ যে সেখানে তাকালেই মনে হয় আকাশের সব রঙ তার মধ্যে মিশে গেছে। দিঘির চারপাশের পরিবেশও যেন দিঘির মতোই শান্ত, নির্জন।
তুলি, মায়াবনের এক মেয়ে। তার চেহারার মাধুর্য, কোমল স্বভাব, আর মনোমুগ্ধকর হাসি এলাকায় সকলের প্রিয়। কিন্তু তার মনে ছিল এক গভীর বিষণ্ণতা, যে বিষণ্ণতা সে কখনো কারো সঙ্গে শেয়ার করত না। প্রতিদিন বিকেলে, যখন সূর্যের আলো নরম হয়ে আসে, তখন তুলিকা মায়ার দিঘির পাড়ে এসে বসে। প্রকৃতির স্নিগ্ধতা আর দিঘির শীতল জলে তার মন প্রশান্ত হয়, আর সেই সঙ্গে শুরু হয় একাকী কল্পনায় ডুবে থাকার মুহূর্ত।
একদিন বিকেলে, তুলি দিঘির পাড়ে বসে ছিল। হঠাৎ সে দেখতে পেল, দিঘির জলে যেন কিছু একটা নড়ছে। প্রথমে ভয় পেলেও, পরমুহূর্তেই সে দেখতে পেল, এক অদ্ভুত সুন্দর পুরুষ দিঘির জলে উঠে আসছে। তার মুখে মৃদু হাসি, চোখে এক রহস্যময় দীপ্তি, আর তার পুরো চেহারায় যেন এক অদ্ভুত মায়াবী আভা। তুলি বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
অপরিচিত পুরুষটি মৃদু স্বরে বলল, “আমি নীল, মায়ার রাজ্যের এক রাজপুত্র। আমি বহুদিন ধরে এই দিঘির তলে বসবাস করি, আর তোমাকে প্রতিদিন এখানে বসে থাকতে দেখি। তোমার কোমল হৃদয় আমাকে স্পর্শ করেছে। আমি তোমার বন্ধু হতে চাই।”
তুলি অবাক হলেও, নীলাভের কথা শুনে তার মন কেমন যেন প্রশান্তিতে ভরে গেল। সে উত্তর দিল, “কিন্তু তুমি তো মানুষ নও, তুমি কিভাবে আমার বন্ধু হবে?”
নীল মৃদু হাসল এবং বলল, “আমার এই মায়ার জগতে সবকিছু সম্ভব। তুমি যদি সত্যিকারের বন্ধুত্বে বিশ্বাস করো, তবে আমরা একে অপরের বন্ধু হতে পারি। তবে আমার এক শর্ত আছে—তুমি প্রতিদিন এই দিঘির পাড়ে আসতে হবে, নাহলে আমি আবার আমার মায়ার রাজ্যে ফিরে যেতে বাধ্য হবো।”
তুলি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, “আমি প্রতিদিন আসবো, আমি তোমার বন্ধু হতে চাই।”
তাদের বন্ধুত্ব এভাবেই শুরু হলো। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তুলি মায়ার দিঘির পাড়ে আসত, আর নীল উঠে এসে তার সাথে গল্প করত। তারা একসাথে সুখ-দুঃখের গল্প করত, আর তাদের বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকল। নীল তুলি তার মায়ার রাজ্যের গল্প শোনাত, যেখানে সবকিছুই সুন্দর আর মায়াবী। তুলি তার জীবনের ছোট ছোট গল্প শেয়ার করত, আর নীল তা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনত।
কিন্তু দিন যতই এগোতে লাগল, ততই তুলি জীবনে দুশ্চিন্তা আর দায়িত্বের ভার বাড়তে লাগল। একদিন, গ্রামের মানুষদের মধ্যে এক মহামারী ছড়িয়ে পড়ল। তুলি বাবা-মা এবং অনেকেই এই মহামারীতে আক্রান্ত হল। তুলি এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, নীল কথা তার মনে রইল না।
দুইদিন পর, এক রাতে তার মনে পড়ল নীল শর্তের কথা। সে দৌড়ে মায়ার দিঘির পাড়ে গেল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখল, দিঘির পানি স্থির আর অন্ধকার। নীল কোনো চিহ্ন নেই। তার চোখে জল ভরে উঠল। সে ব্যাকুল হয়ে নীল নাম ধরে ডাকতে লাগল, “নীল! তুমি কোথায়? আমি এসেছি, তুমি ফিরে এসো!”
কিছুক্ষণ পর, দিঘির পানি থেকে নীল মৃদু মুখ ফুটে উঠল। তার মুখে বিষণ্ণতা আর চোখে এক গভীর বেদনা। নীল বলল, “তুলি, আমি জানতাম তুমি আসবে, কিন্তু সময় শেষ হয়ে গেছে। আমি চিরদিনের জন্য আমার মায়ার রাজ্যে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছি। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছো, তাতে আমি খুশি। কিন্তু আমার জন্য তুমি আর কিছুই করতে পারবে না।”
তুলিকা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “নীল, আমি তোমাকে ভুলে যাইনি। আমার দায়িত্ব ছিল, তাই আসতে পারিনি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো।”
নীল মৃদু হাসল, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে ছিল গভীর বেদনার ছাপ। সে বলল, “তুলি, তোমার কোনো দোষ নেই। আমি জানি, তুমি আমাকে ভুলে যাওনি। কিন্তু আমি মায়ার রাজ্যের শাসনে বাঁধা। এবার আমার বিদায় নিতে হবে। তুমি ভালো থেকো। আমি তোমার বন্ধুত্বকে চিরকাল স্মরণে রাখবো।”
এই কথা বলে নীল ধীরে ধীরে দিঘির জলে মিলিয়ে গেল। তার চেহারাটা জল থেকে মিলিয়ে যেতে যেতে একটি মৃদু হাসি মুখে রয়ে গেল। তুলি নীরবে দাঁড়িয়ে রইল, তার মন বেদনার্ত হলেও, নীল শেষ কথাগুলো যেন তার হৃদয়কে একটু হলেও শান্তি দিল।
এরপর থেকে তুলি আর কখনো মায়ার দিঘির কাছে যায়নি। তার মনে নীল স্মৃতি চিরকাল জীবন্ত রয়ে গেল। তুলি তার জীবনের বাকি দিনগুলো তার পরিবারের সেবা এবং গ্রামের মানুষের সহায়তায় কাটিয়ে দিল। তার মনোরম ব্যক্তিত্ব এবং সহযোগিতামূলক মনোভাব তাকে এলাকায় মানুষের কাছে আরও প্রিয় করে তুলল। আর মায়ার দিঘি? সেটি আজও সেই জায়গাতেই রয়ে গেছে, অপেক্ষায় যেন কেউ আবার সেখানে এসে তার মতো কোনো সত্যিকারের বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করবে।
এলাকায় মানুষজন মায়ার দিঘির রহস্যময়তা নিয়ে আজও গল্প করে। তারা বলে, “মায়ার দিঘির জলে যারা সত্যিকারের বন্ধুত্বের মায়া খুঁজবে, তারা হয়তো সেই মায়াবী জগতে ঢুকে যাবে।” তুলি জীবনের গল্প আর মায়ার দিঘির গল্প মিলেমিশে আজও সেই গ্রামে কাহিনির মতো বেঁচে আছে।
Leave a Reply