“কুম্ভকর্ণ”-সুনীল নামটা বেঞ্চে কম্পাস দিয়ে খোঁদাই করেই হাত দিতে আড়াল করে দিল। চন্দ্রিমা মিসের চোখে পড়লেই সর্বনাশ-আর হল ঠিক তাই। মুহূর্তেই রেগে আগুন হয়ে তিনি সুনীলকে বাইরে পাঠিয়ে তেলে বেগুন করে দিলেন। সুনীল বাইরে বেরিয়ে দরজার ওপারে দেওয়াল ঘেঁসে যতটা পারাযাই কোনাতে গিয়ে ঢুকে দাঁড়াল। রাগি মিসের রাগ সহ্য করে এবার সে গজগজ করতে লাগল-“বাড়িতে রোজ ঝামেলা করে আসবে, আর রাগটা আমার ওপর ঝাড়বে- এই হচ্ছে এনার থিয়োরি!”
সুনীল শান্ত স্বভাবের ছেলে। লিখতে ভালোবাসে, আঁকাতেও হাত ভালই। কোন ঝামেলায় থাকে না, কেউ তাকে কিছু বললে ‘কাম-ব্যাক’করতেও তার মনে হয়ে খাটনি হচ্ছে খুব। চুপচাপ থাকে এবং পরে একটু গজগজ করে রাগ শান্ত করে নেয়। তবে ওর সব থেকে লজ্জার বিষয়- ও সাঁতার জানেনা। ক্লাসের ছেলেরা খোঁটা দিয়ে দিয়ে অতিষ্ট করে তুলেছে তাকে এতদিনে।
৫’৭ ফুট, চোখে স্কয়ার ফ্রামের চশমা, ভাষা ভাষা দৃষ্টি, এবড়ো-খেবড়ো চুল এবং হাল্কা হাল্কা দাড়ি; এই হল একাদশ শ্রেণিতে পড়া সুনীল।
এক হাত পকেটে, আরেক হাত কানে দিয়ে এমন করে দাঁড়িয়ে আছে, যেন কিছুই হয়নি, একটু বাইরে দাঁড়িয়ে কান চুলকাতে ইচ্ছে করছে খালি! আশেপাশে দেখে নিল একবার- শ্রী দেখছেনা তো? অবশ্য একদিন ছাড়া ও কখনই শ্রী’কে দেখেনি স্কুলে।
শ্রী হোল যাকে দুই কথায় বলে ‘বোঝাতে পারবোনা।’ কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল, মুখে কথার থেকে হাসি বেশি, অবশ্য আওয়াজ করে নয়, ফিক ফিক করে। চোখে মোটা ফ্রেমের রঙ চটা চশমা। প্রায় ৫১ ফুট মতো উঁচু, একটু লেখালিখিও করে। কী লেখে দেখায় না কাউকে। আর স্কুলে সচরাচর দেখা যায়না।
সেদিন ছিল অগাস্টের ১৫ তারিক। সকালবেলা স্কুলে ঢুকেই সেটা মনে পড়ল সুনীলের। ওর তো মাথায় হাত। বাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছে, ঠিক তখন একটা বিশাল হাত এসে চেপে ধরল সুনীলের কাঁধ। “কিরে! যাস কই?” সুনীল বোঝে তার আর নিস্তার নেই। “চুপচাপ কাজে হাত লাগাও বাবা, কম্পিউটার ল্যাবে বেলুন রাখা আছে, হাওয়া ভর গিয়ে। কল্লোলের কথা অমান্য করার কথা ভাবতেই পারেনা স্কুলের কেউ- পারসোনালিটিই এমন ওর। তবু একটু চেষ্টা করে দেখল সে,-“বলছি কল্পলদা, আমি একটু বাড়ি হয়ে আসি?”
“দেখ, কেঁচো তোর প্রিয় তো?…আর বেশি বকলে এমন মারব, ওদের সাথেই থাকতে হবে বলে দিলাম।” সেদিন আবার সুনীল গজগজ করতে করতে ল্যাবে গেছিল, এবং গিয়েই দেখেছিল মেয়েটাকে। নানা, পছন্দ নয়, মেয়েটাকে একটু ছিটগ্রস্ত বলে মনে হয়েছিল। শ্রী বসেছিল হাতে খাতা পেন নিয়ে। “খাতাটা দেখছি” বলে খাতাটা সুনীল ওর হাত থেকে নিতেই মেয়েটা তারস্বরে চিৎকার করে উঠল- “তুমি আমার খাতায় হাত দেওয়ার কে?” বলেই সুনীলের দিকে তাকিয়ে একবার যেন একটু সন্তুষ্ট। ফিক ফিক করে হাসল। বলল, “আরে এতক্ষণ তোমার অপেক্ষা করছিলাম গো! বসো! আর কিছু বেলুন নিয়ে এসো, কল্ললদা কাজ না করতে দেখলে আর রক্ষে থাকবেনা।” সুনীল তো হতচকিত- বলে কী মেয়েটা! সে তখন একটা চেয়ার নিতে পিছন ফেরে, তার পরে চেয়ারটি নিয়ে ফিরে এসেই দেখে, মেয়েটা উধাও, খাতাটাও নেই! খালি একটা কাগজের টুকরো পড়ে আছে। সুনীল ভদ্রতার খাতিরে তুলল না সেটা।
“কল্লোল দা! ও কল্লোল না! এইখানে কোন মেয়েকে দেখলে?”-জিজ্ঞেস করল সুনীল।
“মেলা জ্বালাস না তো! পুরো গেছে তোমার মাথাটা বাবা!” কল্লোলের ঝাড় খেয়ে কাজে ফের হাত লাগাল সুনীল। পুরো স্কুল সাজাতে হবে কিনা।
সেদিন রাতে, সুনীল স্বপ্ন দেখল শ্রী এসে ওকে বলছে- “কিগো! এসো তো কাল একবার পুকুর পাড়ে, কথা আছে।” পরের দিন সকালে সুনীল স্কুলে গেল বটে, কিন্তু সারাদিন ওর মন পড়ে রইল আগের রাতে দেখা স্বপ্নতে। সারাক্ষণ খালি যেন কেউ এসে কানের কাছে এসে বলে যাচ্ছে- “এসো তো কাল একবার পুকুর পাড়ে, কথা আছে।” সুনীলকে সেদিন যেন একটু অন্যমনস্ক লাগছে- কী করছে নিজেই যেন জানেনা। তার উপর চলছে বিচ্ছিরি অনেকের ক্লাস। পেছন বেঞ্চে বসা রানা তার মাথায় সুযোগ বুঝে এক চাটি বসিয়ে দিল। রাগে ক্ষোভে ফুঁসছে, তবু কিছু করতে পারছেনা- এমন অবস্থায় সুনীল বেঞ্চে কম্পাস দিয়ে খোঁদাই করতে লাগল, এবং চন্দ্রিমা মিসের চোখে পড়তেই দিলেন তিনি ক্লাস থেকে বার করে। প্রথমে রাগ হচ্ছিল ঠিকই, তবে পরে আবার সেই এক কথা ওর মাথাই ঘিরতে থাকল-“ কিগো! এসো তো কাল একবার পুকুর পাড়ে, কথা আছে।”
সেদিন দুপুর বেলা স্কুলের পরে গেল সুনীল পুকুর পাড়ে। দুই ঘণ্টা বসে রইল সেখানে। কই, কেউতো এলনা! নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গেল সেদিন। সেদিন রাতে আবার স্বপ্ন দেখল যে শ্রী বলছে-“গেছিলে? কই দেখলাম না তো! ও… তখন খেতে বাইরে গেছিলাম। কালকে এসো, পুকুরের কাছে পা ডুবিয়ে বসবে। এসো কিন্তু!” পুকুরের জল সেদিন চাঁদকে টেনে নামিয়ে দিয়ে, ভানুকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করল তারপর। স্কুলে গেল সুনীল। আজ সে যেন ক্লাসের বসে নেই, কথাই হারিয়ে গেছে! মরার মতন দৃষ্টিতে খালি সামনের দেওয়ালের দিকে দেখছে, তবে সে যেন দেওয়ালকে দেখছে না, দেওয়াল ভেদ করে তার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে অনেক দূরে। স্কুলের পর কারোর সাথে কোন কথা না বলে সোজা পুকুরে হাটু পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে রইল। অপেক্ষায়। অপেক্ষা করছে ও। কাছেই কিছু ছোট ছেলেরা খেলা করছিল। তারা ওকে “ওই পাগলা!” বলতেই, ও এমন করে লাল চোখে তাকাল, ওরা এক ছুটে বাড়ি পালাল।
সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে ও যেন একেবারে অন্য মানুষ। মা খেতে ডাকলে পৈশাচিক এক চিৎকার করে ঘরে ঢুকে গেল। সেদিন রাতে শ্রী আবার স্বপ্নে এলো। আজ প্রথমবার সুনীল নিজের স্বপ্নে কথা বলতে পারছে। আগের কিছুদিন শ্রী খালি বলত আর ও পুরো বোবা হয়ে থাকতো। আজ ও বলল-“তুমি কে! চলে যাও! ছেড়ে দাও আমাকে! আমি…আমি তোমার কথায় চলছি! আমি জল ভালবাসিনা! আমি পুকুরে যাবনা! আমি সাঁতার জানিনা! আমাকে আমাকে ছেড়ে দাও..!” শ্রী আজ রোজকার মতন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। সে আজ এগিয়ে এলো। আজ যেন খুব মায়াবী লাগছে তাকে। সরু আঙ্গুলটা আস্তে করে রাখল সুনীলের ঠটে। বলল-“এমন বলছ কেন? তুমি কি আমাকে দেখতে চাওনা বলো? আজ এসো না আবার। আমি অনেক গভীরে থাকি। অনেক গভীরে। তাই তো উঠে আসতে পারিনা! তুমি এসোনা আমার কাছে! আসবে কিন্তু, তোমাকে আসতেই হবে!” তারপরে এক মৃদু হাসির সাথে কানে তালা-লাগান শব্দ শুরু হোল, যার তীব্রতা ক্রমাগত বেড়ে চলছে। আর সুনীলের হাঁটা চলার ক্ষমতাও চলে যাচ্ছে… মাথাটা খুব ব্যথা করছে! ও ঘুম থেকে উঠবে তো? নাকি কুম্ভকর্ণের মতন ঘুমিয়েই থাকবে! ছয়মাস লাগবে না একবছর?… আর ভাবতে পারছেনা সুনীল।
সুনীকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরের দিন সকালে, পাড়ার পচা পুকুরে কার যেন জামাকাপড় ভেসে ওঠে। পুলিশ আসে, তদন্ত করে, বাড়ির লোক চিন্তেও পারে জামাগুলিকে। খুন বলে সন্দেহ হয়না কারোর, সেটাই স্বাভাবিক, মা, স্কুলের মিস এবং স্কুলের ছাত্ররা সবাই জানায় যে শেষ কিছু দিনে তার মধ্য মানুষিক বিকৃতির লক্ষণদেখা দিয়েছিল। সবাই ধরেই নেয় যে ও পুকুরে সাঁতার কাটা শিখতে গেছিল, কিন্তু পাগলের মাথায় এটা আসেনি যে পচা পুকুরে একা সাঁতার শেখা যায়না। তাই ঝাপ দিয়ে ডুবে মারা যায়। খালি কাছের বস্তির একটি ছেলে তার মাকে বলতে লাগল-“ও…ও সাঁতার কাটছিলনা মা, ও নিচে হেটে হেটে চলে গেছে! আমি দেখেছি!”
ময়লা জীর্ণ সাড়ি পরা মা তাকে কোলে বসিয়ে মাথায় চুমু খেয়ে গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,- “কী
কস্ রে, তুই ও পাগল হলি নাকি রে ব্যাটা! আমি কী করব তাহলে!”
স্কুলের ঝাড়দারের সেদিন কাজের শেষ নেই। চারিদিকে বেলুন আর কাগজ ছড়িয়ে। সব পরিষ্কার করতে হবে। এত কাগজ সব ফেলতে হবে! ১৫ই অগাস্ট এলেই এক ঝামেলা। এত কাগজের মাঝে সে খেয়ালই করলোনা যে একটা ডায়েরির পাতা মুক্তর মতন হাতের লেখায় লেখা-
” অনেক অনেক ছড়িয়ে আছে,
দেখতে যদি পাও-
তুমিও ঠিকই হারিয়ে যাবে
এইটা জেনে নাও।।
দেখতে পুরো মানুষ যেন,
তেমনি কথা বলে-
ইচ্ছাশক্তি শুষে যে খায়,
স্বপ্ন দেখার ছলে।
মাথায় তোমার ঢুকে ওরা,
কাছে টেনে কবে-
“ওরে তুই মরত আগে,
শ্রাদ্ধ পরে হবে!”
Leave a Reply